Uncategorized

সন্দীপ দত্ত। আমার স্মরণে

সন্দীপ দত্ত, একজন কবি, প্রাবন্ধিক এবং গ্রন্থাগারিক, যিনি গত চল্লিশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন, ১৫ মার্চ ২০২৩-এ মারা যান।

বহু বছর আগেকার তোলা, ছবিতে অ্যালবার্ট অশোক ও সন্দীপ দত্ত

সন্দীপ দত্ত এককভাবে লিটল ম্যাগাজিনগুলির জন্য একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের (অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিনে লেখা) গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তেমন সুপরিচিত লেখকদের নিয়ে কাজ করা গবেষকদের জন্য অন্যতম প্রধান সম্পদ।

লিটল ম্যাগাজিনে এমন সব গম্ভীর ভাবনা, এমন অচেনা ব্যক্তিত্বের লেখা থাকে, যা না গবেষণার সুযোগ পেলে তা হারিয়ে যায়। লিটল ম্যাগাজিন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য পায় বলেই অনেক স্বাধীন বক্তব্য পেশ করা যায়।
ব্যবসায়িক প্ত্রিকা, আর্থিক লেনদেন নিয়ে থাকে, সেখানে অনেক দায়িত্ব বেশি, কিছু আইনের গন্ডী থাকে। সেই তুলনায় অতি অল্প সংখ্যক প্রকাশিত সংস্ক্রণ নিয়ে ক্ষুদ্র পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। এবং হারিয়ে যায়। এই হারাণো থেকে বাঁচিয়ে রাখা ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ পত্রিকাকে সন্দীপ দত্তের পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা যারা কোনদিন আনন্দবাজারের লবিতে তেল মারার সুযোগ আসেনি, আসলে কেউ বিখ্যাত হতে চায় বলেই বিখ্যাত মানুষদের ছায়া হয়ে, গোলামী করে করুণার পাত্র হয়ে ওখানে চাকরি করতে যায়। আনন্দবাজারে তো লক্ষ লক্ষ কবি প্রাবন্ধিক উপন্যাসিক ছেপেছে। বলুনতো কয়জনকে আপনি মনে করতে পারেন? বিখ্যাত হওয়া হল যেকোন লোককে বহুল প্রচারিত মাধ্যমে তার লেখা(ট্র্যাশ বা মেরিটের) বার বার ছাপা হলে প্রচার বাড়ে আমরা সাধারণলোকেরা বলি বিখ্যাত। যদি সত্যিই আনন্দবাজার রাজা বানানেওয়ালা হতো তা হলে বাংলা থেকে অনেক আন্তর্জাতিক লেখক আমরা পেতাম। বাংলা তো বন্ধ্যা ভূমি। বরং এই ক্ষুদ্র পত্রিকায় যে ব্যক্তি তার মনের কথাটা বলতে পেরেছেন তা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, লিটল ম্যাগাজিনের পাঠাগার থেকেও তার হাত আকাশ ছুঁতে পারে।
(আনন্দবাজার নামটা আমি উল্লেখ করলাম, এটা একটা ্সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির প্রাচীনতম ও জনপ্রিয়তা এত তুংগে যে বাংগলার শিল্প সাহিত্যের সংস্কৃতি ও খবরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির একক দায়বদ্ধতা ও কোনরূপ অযাচিত বিতর্ক আনতে চাইনা। এখানে আনন্দবাজার মানে বাংলার সকল প্ত্রপত্রিকা যারা ব্যবসা করে ও বাঘ বানিয়ে মানুষকে চিত্তবিনোদন করে বুঝতে হবে।)

আমি কলেজস্ট্রীট পাড়ায় প্রকাশন বিভাগে গোটা ৫০ এর অধিক প্রকাশনের সাথে কাজ করেছি, ১৯৮২ সাল থেকে ২০০৪ অব্দি। অনেক প্রকাশককে প্রকাশনা বাতি নিবিয়ে দোকান বিক্রী করতে দেখেছি। দেখেছি আস্তে আস্তে প্রকাশকদের শিল্পী লেখক মূদ্রক বাইন্ডার এদের ঠকিয়ে ব্যবসা চালাতে গিয়ে পরিণতি হিসাবে নিজেরাই ঝাপ বন্ধ করে চলে গেছেন। শুনেছি বাংলাদেশের ঢাকা নাকি আরো ভয়ঙ্কর জায়গা।
আমার অনেক স্ক্রিপ্ট/ ড্রয়িং কাজ অনেকে নিয়ে ছাপবে বলে আর ফেরত দেয়নি। হারিয়ে গেছে সেই সব পরিশ্রম। আবার অনেক বড় ব্যবসায়ী কাজ করিয়ে নিজের ইচ্ছামতো সে কাজের পয়সাও দেয়নি, কাজও ছাপেনি। আজকে কলেজস্ট্রীটের অনেক প্রকাশক কবিতা গল্প উপন্যাস ইত্যাদি নিজের পয়সায় ছাপেনা। ছাপলেও বিক্রী করতে পারেনা। বই প্রমোট করার দায় এসে পড়ে লেখকের ঘাড়ে। আমাদের *ষষ্টি দা, নিজের বই নিজেই কি করে বিক্রী করতেন অবাক হতাম। তখনও তিনি জনপ্রিয় লেখক হননি। বই তখন ইংরেজি থ্রিলার/ডিটেক্টিভ ইত্যাদি গোছের অনুবাদ সাহিত্য বেরোলে লেখক ২৮ কপি পেতেন এবং সেগুলি বিক্রী করে নিজের আর্থিক লাভ বুঝে নিতেন। ছাপা হতো ১১০০ কপি।

*ষষ্টিপদ চট্টোপাধ্যায়, পান্ডব গোয়েন্দার লেখক


এখন তো ছাপাই কমে গেছে কবিতা বই লেখক ছাপে ৫০/১০০ কপি এবং বিনা পয়সায় বন্ধুদের বিতরণ করতে হয়, বন্ধুরা অতিউষ্ণতা দেখিয়ে নিয়ে যান বাড়ি গিয়ে নোংরার ঝুড়িতে ফেলে দেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন আরে বইটা পড়তে পারলামনা একজন কেড়ে নিয়ে নিল সে ফেরত দিলে পড়ে জানাব।
এসবের চেয়ে ক্ষুদ্র পত্রিকায় আপনার ক্ষুদ্রতম লেখাটাও যদি সম্পাদকের তেল মর্দন করে ছাপাতে পারেন তবু লেখক অনেক সম্মানীয়। আর তার গাঁটের পয়সা বেঁচে যায়। ক্ষুদ্র পত্রিকায় দীর্ঘদিন লেখলে তার যে জনপ্রিয়তা হয় তা খাঁটি থাকে ফলে তার প্রতিষ্ঠা পাবার আশা গড়ে উঠে। আজকাল তো ছাইপাশ অনেকেই পকেটের টাকা দিয়ে ছেপে কোন মহিলার সংগ পেতে চান। তারা এটাও জানেন যে তারা কোনদিন লেখক হবেননা ঐ মহিলার সংগটুকু ওই কবিযশে যদি ইম্প্রেশড্‌ হয়ে পান।

সাহিত্যের সেদিন আর নেই।শিল্প সংস্কৃতি একগুচ্ছে বদমায়েসের জন্য শ্রদ্ধাভক্তি উঠে গেছে। কিছু তরুণ তরুণী এখনো ক্ষুদ্রপত্রিকা পড়েন ও তা নিয়ে ভাবেন, এটাই ইতিবাচক।

সময়ানুগ বলে একটা ক্ষুদ্রপত্রিকা পরলোকগত আমাদের প্রিয় দেবু দা (দেবকুমার বসু) দর্শক পত্রিকার সম্পাদক, চালাতেন। ওতে আমার একটা কবিতা প্রকাশের সূত্রে আমি টেমার লেনের গলিতে ঢুকি। এবং সেখানথেকেই সন্দীপদা’র সাথে পরিচয়। গুরুজন হিসাবে তার সান্নিধ্য পাবার ইচ্ছা জাগত। পার্কস্ট্রিট/ময়দানের বইমেলাতে প্রতি বছর দেশবন্ধু পার্ক থেকে দেবু দার নেতৃত্বে বহু কবি ও গুণিজন মিছিল করে বইমেলায় সকাল/দুপুরে যেতাম আর বিনা পয়সায় ১ ঘন্টার জন্য বইমেলা কর্তৃপক্ষা ইউ বি আই মঞ্চ কবিতা পাঠের জন্য দিতেন। বহু বছর আমি ও আমরা সেখানে কবিতা পাঠ করেছি , দেখতাম সন্দীপ দা সেখানে মাথায় প্ল্যাকার্ডের টুপি বানিয়ে হাঁছেন তার গ্র্নথাগারের প্রচার করছেন।

একটা ক্ষয়িষ্ণু সমাজে আমরা বর্তমান এসে পড়েছি। এর জন্য পূস্তক প্রকাশনার গিল্ড থেকে অনেকেই দায়ী রাজনীতি ও রাজ্য সরকার তো বটেই।

সন্দীপ দা কে নিয়ে আমার স্মৃতিকথা লেখার ইচ্ছা ছিল আজ দেখলাম ফেবু মনে করিয়ে দিল।